শিরোনামঃ-

» অভাজনের বাজেট ভাবনা

প্রকাশিত: ১২. জুন. ২০১৭ | সোমবার

মো. আব্দুল মালিকঃ দেশের উন্নয়নের জন্য ট্যাক্স ভ্যাট প্রদান করা নাগরিকের দায়িত্ব। নাগরিকরা যত বেশী ট্যাক্স ভ্যাট প্রদান করবেন সরকার তত বেশী দেশের উন্নয়নে, জনকল্যাণে ব্যয় করতে পারবেন। অর্থনীতিতে একটি কথা আছে, জনগণের ব্যয় সরকারের আয়, সরকারের ব্যয় জনগণের আয়। সরকার ট্যাক্স ভ্যাট আদায়ে এমন নীতিমালা প্রণয়ন করবেন যাতে সকল নাগরিকের প্রতি সমান ন্যায় বিচার সূচীত হয়। যেখান থেকে বা যাদের থেকে সহজেই ট্যাক্স ভ্যাট আদায় করা যায় শুধু সেখানেই বার বার ট্যাক্স ভ্যাট বৃদ্ধি করা হলে সৎ ও সাধারণ মানুষ বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হন। এদিকে অবশ্যই সরকারের খেয়াল রাখা উচিত।

২০১৭-১৮ সালের ঘোষিত বাজেটে অর্থমন্ত্রী মহোদয় ব্যাংকে গচ্ছিত একলক্ষ টাকার উপরে হলে আবগারী শুল্ক ৫০০ টাকার স্থলে ৮০০ টাকার প্রস্তাব করেছেন। এই নিয়ে সর্বমহলে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। একজন গ্রাহক ব্যাংকে রাখা তার এই টাকার ওপরে ইতিপূর্বে হয়ত আয়কর দিয়েছে বা ক্ষেত্র বিশেষে অন্যান্য ট্যাক্স, রেভিনিউ ইত্যাদি দিয়েই ব্যাংকে গচ্ছিত রেখেছে। ব্যাংকে গচ্ছিত টাকার ইন্টারেস্ট বর্তমানে ৪/৫% এর বেশী নয়। হিসেব করে দেখা গেছে কোন গ্রাহকের ব্যাংকে একলক্ষ এক টাকা জমা থাকলে বৎসর শেষে আবগারী শুল্ক ৮০০ টাকা, ব্যাংকের দেয় ইন্টারেস্টের উপর আয়কর ক্ষেত্র বিশেষে ১০/১৫% এবং ব্যাংকের সার্ভিস চার্জ প্রদানের পর তার মূলধন একলক্ষ একটাকা থেকে আরো কমে যাবে। এমনিতেই ব্যাংক রেইট কম থাকায় বর্তমানে ব্যাংকে ক্ষুদ্র সঞ্চয় কমে গেছে। তদুপরি প্রস্তাবিত আবগারী শুল্ক বাস্তবায়িত হলে ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীরা আর ব্যাংকমূখী হবেননা। ফলে সরকারের এখাতে ব্যয় কমবে, ব্যংকগুলোও ক্ষতিগ্রস্থ হবে। এমনকি ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীরা ক্ষতিগ্রস্থ হবেন। তাদের সঞ্চয় না থাকার কারনে বিপদের সময় অসহায় হয়ে পড়বেন। তাই ক্ষুদ্র সঞ্চয়ী, সরকারের আয় ও ব্যাংকের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে এ ব্যাপারে সরকার সঠিক সিদ্ধান্ত নেবেন এটাই জনগণের প্রত্যাশা। তাছাড়া এ বাজেটে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের উপর ট্যাক্সের বোঝা চাপানো হয়েছে। সে অনুযায়ী উচ্চবিত্তদের উপর ট্যাক্স চাপানো হয়নি। তবে সরকারের অন্য অনেক জায়গায় কর আদায়ের সুযোগ রয়েছে। যেমন-

১। যদিও বাজেটে গ্যাসবিল বাড়ানো হয় নি। তবে বাজেটের পূর্বে মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে ৬৫০ টাকার গ্যাস বিল দুইবারে বৃদ্ধি করে ৯৫০ টাকা করা হয়েছে। এই বাড়তি বিল অবশ্যই জনগণের বাজেটে চাপ বৃদ্ধি করবে। তাছাড়া গ্যাসভিত্তিক উৎপাদিত দ্রব্যমূল্যও বৃদ্ধি পাবে। আমরা সবাই বিদ্যুৎ, টেলিফোন ইত্যাদি ব্যবহার করি এবং এসব ক্ষেত্রে ব্যবহার অনুযায়ী বা ন্যুনতম বিল পরিশোধ করে থাকি। কিন্তু গ্যাসের ক্ষেত্রে তা উল্টো। দুই সদস্য বিশিষ্ট একটি কর্মজীবী পরিবারে চুলা হয়ত বড় জোর দিনে ৩০/৪০ মিনিট জ্বলে অনেকক্ষেত্রে জ্বলেও না। তিনি বিল দিবেন ৯৫০ টাকা আর যে হোটেল বা ২০/৩০ সদস্য বিশিষ্ট পরিবার সারাদিন গ্যাসের চুলা জ্বালিয়ে রান্না করবে কাপড় শুকাবে-সেও দিবে ৯৫০ টাকা। এ কেমন নিয়ম? যদি গ্যাসের চুলায় মিটার লাগানো হয় তাহলে গ্যাসের অপচয় রোধ হবে, চুরি বন্ধ হবে, গ্রাহকরা ব্যবহার অনুযায়ি বা নুন্যতম বিল পরিশোধ করবেন। এতে সমাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। অথচ মিটার লাগাতে সরকারের কোন খরচ লাগবে না, মিটার খরচ গ্রাহকরাই বহন করবেন। বিজ্ঞজনের মতে অসাধু কর্মকর্তা কর্মচারীরা মিটার লাগানোর বিপক্ষে। কারণ এতে তাদের অবৈধ সংযোগ দিয়ে অতিরিক্ত আয় বন্ধ হয়ে যাবে।

২। সরকারী বেসরকারী অনেক কর্মকর্তা কর্মচারী আয় কর প্রদানের মত বেতন স্কেলে চাকুরী করেন কিন্তু তারা কোন আয়কর দেন না। এদের সবাইকে আয়করের আওতায় আনলে সরকারের আয় বাড়বে। এজন্য সংশ্লিষ্ট অফিস প্রদানকে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ পত্র দিয়ে নীতিমালা জানিয়ে দিলে এবং সংশ্লিষ্ট বেতনবিল প্রস্তুতকারী কর্তৃপক্ষ আয়কর কর্তন করে বিল তৈরি করলে সহজেই আয়কর সংগ্রহ হয়ে যাবে।

৩) ব্যবসা-বাণিজ্য বর্তমানে আর শহর কেন্দ্রিক নেই। গ্রামে-গঞ্জে অনেক বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এসব ব্যবসায়ীদের করের আতওয়ায় নিয়ে আসলে আয়কর বাড়বে।

৪। সরকার বাড়িওয়ালাদের কাছ থেকে ঠিকমত আয়কর পাচ্ছেন না। অথচ বাড়িওয়ালারা বছর বছর বাড়িভাড়া বৃদ্ধি করে লক্ষ লক্ষ টাকা আয় করছেন। এক্ষেত্রে বিদ্যুতের মিটার, গ্যাসের চুলার মালিকানা অনুযায়ী খোঁজ নিয়ে সহজেই সরকার আয়কর আদায় করতে পারেন।

৫। প্রথিতযশা ডাক্তার, আইনজীবী, ইঞ্জিনিয়ার, কানসালটেন্সী ফার্ম আয় অনুযায়ী আয়কর দিচ্ছেন না। এদের কাছ থেকে আয় অনুযায়ী আয়কর আদায় করলে সরকারের আয় বৃদ্ধি পাবে।

৬। প্রাইভেট গাড়ি, মোটর মোটরসাইকেলের কারণে ঘন্টার পর ঘন্টা ট্রাফিক জ্যাম লেগেই থাকে। অনেক ব্যক্তি দামী গাড়ি, বাড়ি ব্যবহার করেন কিন্তু আয়কর দেয়ার সময় খুব কমই দেন। আর অনেক মোটর সাইকেলের মালিক কোন আয়করই দেননা। ব্যবহৃত গাড়ি বাড়ির মূল্যমান অনুযায়ী আয়কর আদায় করা হলে সরকারের আয় অনেক বাড়বে।

৭। বাংলাদেশ শিল্পে অনেক দূর এগিয়েছে। কিন্তু সকল শিল্প প্রতিষ্ঠান ব্যবহৃত সেবার বিল নিয়মিত পরিশোধ করে না বা ফাঁকি দেয়। এসব শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে যথাযথভাবে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি ও অন্যান্য সেবার বিল আদায় করতে হবে। এমন কি অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠান বিদ্যুৎ, গ্যাস বিল নিয়মিত পরিশোধ করে না। এ সংস্কৃতি থেকে সরকারি প্রতিষ্ঠান গুলোকে বের করে আনতে হবে। ফলে সরকারের আয় বাড়বে।

৮। গত অর্থ বছরে রাষ্ট্রায়ত্ব সোনালী ব্যাংকের ৩৪৭৪ কোটি, অগ্রণী ব্যাংকের ২০০ কোটি, রূপালী ব্যাংকের ৭১৪ কোটি, বেসিক ব্যাংকের ২৬৮৪ কোটি, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের ৭৩৭ কোটি, কৃষি ব্যাংকের ৭০৮৩ কোটি, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ৭৪২ কোটি টাকা ঘাটতি রয়েছে। এ ঘাটতি মেটানোর জন্য বাজেটে ২০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। দেশে প্রাইভেট ব্যাংক রয়েছে ৫৯/৬০টি। কোন প্রাইভেট ব্যাংকই লোকসান দিচ্ছে না। প্রাইভেট ব্যাংকে ভর্তুকী দিতে হচ্ছে না বরং এই ব্যাংকগুলি সরকারের বিভিন্ন ফান্ডে মোটা অংকের সাহায্য করছে। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ব খাতের ব্যাংকগুলোকে ১৪৫০৫ কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়া হয়েছে। কেন জনগণের ট্যাক্সের টাকায় এই ভর্তুকী? এই টাকা দিয়ে ২০/৩০ লক্ষ হত দরিদ্র মানুষের জীবন মান উন্নত করা যেত। জনগণ ট্যাক্স দেন দেশের উন্নয়নের জন্য, মানুষের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির জন্য, মিস ম্যানেজমেন্টের কারনে লোকসান পোষানোর জন্য নয়। তাই জনগণের ট্যাক্সের টাকা ভর্তুকী খাতে না দিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ব এসব সাদা হস্তীমার্কা লোকসানী ব্যাংক অবিলম্বে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হলে এগুলোও লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে এবং সরকারের ব্যয় কমবে।

৯। ব্যক্তিখাতে করযোগ্য আয় গতবারের ন্যায় সর্বনিম্ন আড়াই লক্ষ টাকা এবারও রাখা হয়েছে কিন্তু গত বছরে সরকারি হিসেবে মুদ্রাস্ফীতি হয়েছে ৫%। ফলে নিম্ন আয়ের কর্মচারীরা ক্ষতিগ্রস্থ হবেন।

১০। উন্নয়ন বাজেটের ব্যয়ের প্রতি সরকারের আরো মনোযোগ দেওয়া জরুরী। সম্প্রতি পদ্মা সেতুর চাইতে বড় একটি সেতু ভারত সরকার আরো অনেক কম খরচে বাস্তবায়ন করেছে। জনগণের করের টাকা যাতে হরিলুট না হয় সেদিকে সরকারকে সজাগ থাকতে হবে।

১১। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে উপকারভোগী ও বরাদ্দ বাড়ানো হলেও উপকারভোগী নির্বাচন যথাযথ হচ্ছে না। ফুটপাতে যেসব পঙ্গু, বিকলাঙ্গ, বিধবা, বৃদ্ধ, ভিক্ষুক রয়েছে তাদের পূর্ণবাসনে এ বাজেটে কোন বরাদ্দ রাখা হয়নি।

১২। ব্যাংকে হাজার হাজার কোটি টাকা অলস পড়ে আছে। এই টাকা বিনিয়োগ হচ্ছে না। ড. ফরাস উদ্দিন বেতন কমিশন সুপারিশ করেছিল সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারীদের ফ্লাট বাড়ি তৈরীর জন্য গ্র“প ভিত্তিক স্বল্প সুদে কিস্তিতে পরিশোধ যোগ্য ঋণ প্রদানের জন্য। এই কর্মসুচী সরকার যত দ্রুত বাস্তবায়িত ও গতিশীল করবেন তত বেশী অর্থনীতি গতিশীল হবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। বাড়ি সংক্রান্ত জিনিষপত্রের বিক্রিবাট্টা বৃদ্ধি পাবে। ফলে সরকারও নানা ভাবে ট্যাক্স, ভ্যাট ও অন্যান্য ফি পাবেন। কর্মকর্তা কর্মচারীদের আবাসন সমস্যার সমাধান হবে। ব্যাংকে পড়ে থাকা অলস টাকা উৎপাদনে আসবে। যেহেতু সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীরা সরকারের নিকট দায়বদ্ধ তাই এ ধরণের ঋণের টাকা খেলাপী হওয়ার কোন সুযোগ নেই।

১৩। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে এনবিআর কর্তৃক আয়কর প্রদানের যে ফরম আছে সেটি। এই ফরম একজন উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তি ও  পড়ে বুঝে পূরণ করতে পারেন না। সেটি পূরণ করতে উকিল লাগে। তাও সব উকিলে হয় না, ইনকাম ট্যাক্স উকিল লাগে। অনেক নামী দামী উকিলকেও ইনকাম ট্যাক্স প্রদানের জন্য ইনকাম ট্যাক্স উকিলের কাছে যেতে হয়। ফলে ৩০০০ টাকার ইনকাম ট্যাক্স দিতে উকিলকে ৫০০০ টাকা ফি দিতে হয়। আর ইনকাম ট্যাক্স অফিসের কর্তাব্যক্তিদের সম্পর্কে করদাতাদের একটি নেতিবাচক ধারণা আছেই। ফলে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অনেকেই আয়কর দিতে যান না। এই সমস্যা সমাধানে মান্দ্বাতার আমলের এই ফরম বাতিল করে আধুনিক, যুগোপযোগী সহজেই বোধগম্য ধারাবাহিকভাবে পূরণযোগ্য নতুন ফরম চালু করা হলে নতুন করদাতারা উৎসাহিত হবেন।

উপরোক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে সরকারের আয় বাড়বে, জনগণও উপকৃত হবেন বলে বিজ্ঞ জনেরা মনে করেন।

শিক্ষক ও কলামিস্ট

এই সংবাদটি পড়া হয়েছে ৬২২ বার

Share Button

Callender

November 2024
M T W T F S S
 123
45678910
11121314151617
18192021222324
252627282930