শিরোনামঃ-

» বৌ কেনাবেচার হাট

প্রকাশিত: ০৬. জুলাই. ২০১৭ | বৃহস্পতিবার

এক্সক্লুসিভ সংবাদঃ প্রথমবার যখন মোকলেসাকে বিক্রি করা হয় তখন তার বয়স মাত্র ১২। তাকে কিনে নিয়েছিল ৭০ বছরের এক বৃদ্ধ। পরে মেয়েটিকে বিয়েও করেছিল ওই বৃদ্ধ। এরপর একটি সন্তান জন্ম দেয় মোকলেসা। তিন বছর পর মারা যায় তার সেই বৃদ্ধ স্বামী। আবারো ‘বেচাকেনার বাজারে’ তোলা হয় তাকে। কিন্তু এবার মোকলেসাকে যে কিনে নেয় সে ছিল ভয়ংকর স্বভাবের মানুষ।

মোকলেসার ভাষায়, ‘সে আমাকে খেতে দিত না। আমাকে মাঠে নিয়ে গিয়ে মুখে কাদামাটি ঢুকিয়ে দিত এবং মারধর করত।’ ভারতের এমন হাজারো ‘দাসীবধূর’ মতো মোকলেসাও একজন। প্রথমে মেয়েদের বিক্রি করে দেয়া হয়। পরে ক্রেতা ওই মেয়েকে বিয়ে করে। বাকি জীবনটা নির্যাতন সহ্য করেই কাটাতে হয় এসব মেয়ের।

পুত্র সন্তানের আশায় গর্ভপাত আর কন্যাশিশু হত্যার কারণে ভারত বিশ্বের সবচেয়ে লিঙ্গ বৈষম্যের দেশই শুধু নয়, লিঙ্গ ভারসাম্যহীনতায়ও শীর্ষে আছে দেশটি। নারীর সংখ্যা কম থাকায় বিবাহযোগ্য পুরুষের মধ্যে কনের চাহিদা প্রচুর। বিশেষ করে ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্য হরিয়ানার মতো জায়গায়। লিঙ্গ ভারসাম্যহীনতায় এই রাজ্যটি সবচেয়ে এগিয়ে।

এই সুযোগকেই কাজে লাগায় মানবপাচারকারীরা। রাজ্যের কনের চাহিদা পূরণ করতে অন্য রাজ্য থেকে নারীদের অপহরণ করে সেখানে নিয়ে যায় তারা। এরপর বিক্রি করা হয় ক্রেতাদের কাছে। হরিয়ানার ১০ হাজার পরিবারের ওপর এক জরিপ চালিয়ে দেখা যায়, সেখানকার ৯ হাজার বিবাহিত নারীই অন্য রাজ্য থেকে সেখানে গিয়েছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, গ্রামে বাস করা নারীদের অনেককেই তিনবার কিংবা তার চেয়েও বেশিবার কেনাবেচা করা হয়েছে।

স্থানীয় লোকজন কিনে নেয়া এসব নারীকে ডাকে ‘পারোস’ বলে। এর অর্থ, যাকে কিনে আনা হয়েছে। এটি খুবই অপমানজনক একটি ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। হরিয়ানার এমন আরেকজন পারোস সানজিদা। তিনি যখন পাচারের শিকার হন, তখন ১০ বছর বয়স। সানজিদা জানায়, তার চেয়ে বয়সে বড় আসাম রাজ্যের এক মেয়ে তাকে অপহরণ করে এনে বিক্রি করে দেয়।

অপহৃত অবস্থায় থাকার সময় সানজিদাকে দিয়ে মাঠে বিভিন্ন কাজ করানো হতো। ঘাস কাটা, গরুকে খাওয়ানোসহ সব কাজই করতে হতো তার। এভাবে চার বছর কাটে। পরে বিক্রি করে দেয়া হয় তাকে। তার ক্রেতা সানজিদাকে পরে বিয়ে করে নেয়। পালিয়ে আসাও তার পক্ষে সম্ভব ছিল না।

তবে অন্যদের চেয়ে সৌভাগ্যবান সানজিদা। তার ভাগ্যে একজন ভালো ক্রেতা পড়েছিল। সানজিদা জানায়, তার স্বামী সব সময়ই তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে। একই ঘটনার শিকার অন্য নারীদের সাহায্য দেয় এমন একটি বেসরকারি সংস্থায় (এনজিও) বর্তমানে কাজ করেন তিনি। তবে সমাজের মানুষ সানজিদার মতো মেয়েদের স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে না।

সানজিদা বলেন, ‘হরিয়ানার সব মানুষই আমাদের মতো নারীদের প্রতি অশ্রদ্ধা পোষণ করে। সবাই বলে, আমাদের কোনো আত্মসম্মান নেই। এ কারণেই যখন খুশি আমাদের গরু-ছাগলের মতো বিক্রি করা হয়। এ ধরনের কথা শুনলে খুবই খারাপ লাগে, কারণ আমরাও মানুষ। আমরাও তাদের মতো এই ভারতেরই মানুষ।’

বর্তমানে মোকলেসাকে তার স্বামীর নির্যাতন থেকে রক্ষার জন্য কাজ করছেন সানজিদা। মোকলেসা একটি সেফ হাউসে তার ১৮ বছরের মেয়েকে নিয়ে বাস করছেন। তবে সানজিদা জানান, মোকলেসা মানসিকভাবে এতটাই অসুস্থ যে সে তার নিজের ঠিকানাটাও ভুলে গেছেন। তিনি বলেন, ‘মোকলেসার দ্বিতীয় স্বামী ছিল অত্যন্ত নিষ্ঠুর প্রকৃতির। সে মোকলেসাকে এমনভাবে মেরেছে যে তার মুখ থেতলে গেছে। শেষ পর্যন্ত তিনি মানসিকভাবে আক্রান্ত হয়েছেন।’

যারা পালিয়ে আসতে পারেন, তারা অনেকে পাচারকারীদের বিরুদ্ধে মামলা দেন। কিন্তু তাতে পাচারকারীদের কিছুই হয় না বলে জানান হরিয়ানার এক জেলা মুখ্য হাকিম নরেন্দ্র সিং। কারণ যারা এসব করে তারা অত্যন্ত প্রভাবশালী। নিজেদের সম্প্রদায়ের লোকও এসব অপরাধীকে সহায়তা করে। এসব ক্ষেত্রে নারীদের কোনো অধিকার থাকে না বলেও জানান নরেন্দ্র সিং।

ভারতের সমাজসেবা সংস্থা পপুলেশন ফাউন্ডেশন ফর ইন্ডিয়া’র নির্বাহী পরিচালক পুনম মুত্রেজা জানান, বধূ বিক্রির এই বাণিজ্য প্রমাণ করে সাংস্কৃতিকভাবে নারীদের সম্মান দেখানো এখনো শিখেনি এসব সমাজের মানুষ। নারীদের মর্যাদা না বোঝার কারণেই এসব ঘটনা ঘটছে বলেও মনে করেন তিনি।

পুনম বলেন, ‘এটা খুবই আশ্চর্যজনক যে জন্ম নেয়ার আগেও এখানে মেয়েদের মূল্যায়ন করা হয় না। জন্ম নেয়ার পরেও না। নারীদের বেচাকেনা হরিয়ানার এখন একটি স্বাভাবিক রীতি হয়ে গেছে। ছেলেদের অভিভাবকরা চাইলে অন্য রাজ্য থেকে স্বাভাবিকভাবেই তাদের পুত্রদের বিয়ে করাতে পারে। কিন্তু এ ধরনের বেচাকেনার রীতি স্পষ্টতই প্রমাণ করে, এটা নারীদের প্রতি অবমূল্যায়নের ফল।’

এই সংবাদটি পড়া হয়েছে ৪৮৪ বার

Share Button

Callender

September 2024
M T W T F S S
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
30