শিরোনামঃ-

» সব থেকেও যেন তাদের কিছু নেই

প্রকাশিত: ২৮. ডিসেম্বর. ২০১৭ | বৃহস্পতিবার

স্টাফ রিপোর্টারঃ মাঘের এই দিনে উত্তর দিগন্তে হিমালয়ের বরফচূড়া থেকে ছড়িয়ে পড়ে শীতবুড়ির হিম শীতল নিঃশ্বাস। ধরণী হঠাৎ হয়ে পড়ে জড়সড়।

বিবর্ণ হলুদ পাতারা চুপিসারে খসে পড়ে পথের ধুলায়। শীতের দীর্ঘ রাতের কুয়াশার আবরণ গায়ে মেখে সুবহে সাদিকে ভেসে আসে আজানের ধ্বনি।

তখন গাছে গাছে পাখিদের কলকাকলীতে ঘুম ভাঙে মানুষের। ঠান্ডা পানিতে অজু করে নামাজে দাঁড়ায় বড়রা। ছোটরা লেপের নিচে দাদা-দাদীর গা-ঘেঁষে গল্প করে, ছড়া কাটে মিষ্টি সুরে।

ছোটবেলার অনেকেরই শীতের স্মৃতিগুলো এমনই। বর্তমানে শহর এবং গ্রামে শীতের আবহগুলো সত্যিই ভিন্ন রূপ তৈরি করে আমাদের মাঝে।

গ্রামের কৃষকরা সেই সকালবেলা শীত উপেক্ষা করে লাঙ্গল-গরু নিয়ে ছোটে মাঠের দিকে। বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে গেলেই তারা হারিয়ে যায় কুয়াশার মধ্যে।

এভাবেই ভোর হওয়ার কথা গ্রামের কৃষকদের। কিন্তু ভাগ্য বিড়ম্বিত কিছু কৃষকের সেই দিনগুলো যেন আজ শুধুই স্মৃতি। সব থেকেও যেন তাদের আজ কিছু নেই।

ইট সুরকীর দেয়ালে ঘেরা শহরের চিত্র এই শীতেও ভিন্ন। তবে এই ভিন্নতার স্বাদ থেকে আলাদা তারা। শীতের সকালে যখন শহরে বাবুরা গরম চায়ে চুমুক দিয়ে পত্রিকা পড়েন তখন তাদেরকে ছুটে যেতে হয় রিযিকের সন্ধানে।

লক্ষ্য একটাই সন্তানের মুখে দু’মুঠো ভাত তুলে দিতে হবে। খুব বেশী চাওয়া নেই তাদের। বিশাল অট্রালিকা কিংবা অবকাশযান। একটু কম ভাড়ায় থাকা কলোনী কিংবা বস্তিকেই তারা নিজের আবাস বানিয়ে দিনযাপন করছে। তাদের খোজ রাখেনা কেউ।

রাখে যাদের বাসা বাড়ীতে কাজের দরকার কেবল তারাই। শীতের তীব্রতা উপেক্ষা করে জীর্নশীর্ণ পুরাতন শীতের কাপড় কিংবা একটা পুরনো চাদরই তাদের শীত নিবারণের একমাত্র মাধ্যম।

বলছিলাম ভাগ্য বিড়ম্বিত হাওরপাড়ের মানুষের কথা। প্রতিটি মানুষের জীবন জুড়ে রয়েছে পাওয়া না পাওয়া হারানোর অনেক ট্রাজেডী। শত কষ্ঠ বুকে চেপেও মানুষগুলোর মুখে হাসি দেখলে কৃতজ্ঞতায় বুক ভরে যায়। বিবেকের তাড়নায় বুকের গহিন থেকে তাদের জন্য আসে শ্রদ্ধা আর অফুরান ভালবাসা।

শহুরে জীবন যাপনে অভ্যস্ত হলেও ভোরে হাটা চলার অভ্যাস আমার অনেক দিনের পুরনো। তাই শহরের সকালের অনেক দৃশ্যই চোখে পড়ে। কর্ম ব্যস্তুার কারণে অনেক সময় তা দেখেও না দেখার ভান করে এড়িয়ে যাই।

কিন্তু সেদিন ভোরে শহরতলীর মেজরঠিলা থেকে বন্দরবাজার আসতে টিলাগড় পয়েন্টে একটি দৃশ্য দেখেই চোখ আটকে যায়। তাৎক্ষনাক সিএনজি থেকে নেমে পড়লাম।

দেখলাম উড়া কোদাল নিয়ে কিছু মানুষ কাজের সন্ধানের জন্য অপেক্ষমান। এর মাঝে রয়েছেন অর্ধ-বয়স্ক মহিলারাও। তাদের ব্যাপারে কিছু জানার আগ্রহ থেকেই মুলত কাছে যাওয়া। কাছে গেলাম কথা বললাম অনেকের সাথে।

সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে তারা যেন আরো কৌতুহলী হয়ে কার জীবনের গল্প কে আগে বলবে এর প্রতিযোগিতা শুরু করে দিল। আমিও অনেকের সাথে কথা বলে কিছু মানুষের জীবন-জীবিকার গল্প নোট করলাম।

এসব খেটে খাওয়া মানুষকে নিয়েই আমার এই লেখা।

মখলিছুর রহমান সুনামগঞ্জ হাওরপাড়ের মানুষ। তার গ্রামের বাড়ী সদর উপজেলার ইসলামপুর গ্রামে। ২ ছেলে, ২ মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে তার সুখের সংসার। জমি ছিল কয়েক বিঘা।

কিন্তু পর পর দুই বছর শিলা বৃষ্টি ও অকাল বন্যায় জমির ধান বিনষ্ট হওয়ায় জমি করা বাদ দিয়ে সন্তানদের নিয়ে সিলেটে এসেছেন। তাদের নিয়ে থাকেন শহরতলীর একটি কলোনীতে।

বললেন- দুজনের পড়ালেখা বাদ দিয়েছেন অর্থের অভাবে আর দুটি বাচ্চা স্কুলে পড়ছে। শুধু তাদের পরীক্ষার সময় কেবলই বাড়ীতে যান। বাকী সময় থাকেন শহরে।

সকালে বের হন কাজের সন্ধানে। প্রতিদিন কাজ না জুটলেও প্রায় দিনই কাজ পান তিনি। দিনের সাড়ে তিনশ থেকে চারশ টাকা রোজি করে তিনি সংসার চালান।

কতদিন এভাবে চলবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন- এই জবাবটা এখনই দিতে পারছিনা। ভবিষ্যত নিয়ে খুব বেশী চিন্তিত নয় তিনি বললেন- বর্তমানে বেঁচে থাকার সংগ্রামে বিজয়ী হওয়াই তার লক্ষ্য।

নুর রহমান হবিগঞ্জের এক সময়ের সফল কৃষক। নিজের জমি খুব বেশী না থাকলেও জীবন কাটছিল ভালই। কিন্তু গেল বছর বন্যায় ফসল বিনষ্ট হওয়ায় তিনি এখন কাজের সন্ধানে শহরে।

২ মেয়ে, ১ ছেলে ও স্ত্রীকে গ্রামের বাড়ী নবীগঞ্জ উপজেলার লাখাই গ্রামে রেখে তিনি একা এসেছেন শহরে। কাজ করে যা রোজি করেন তা সংসারে পাঠান।

আর এভাবেই চলছে তার সংসার। এ বছর জমি করতে যাবেন না। এমন প্রশ্নের জবাবে নুর রহমান বলেন- জমি করতেও অনেক টাকা লাগে। তারপরও কষ্ঠ করে জমির ধান যদি না পাই তাহলে কষ্ট আরো দিগুন হবে।

জমি ভাগি দিয়ে এসেছেন বলেও জানান তিনি। তিনটি সন্তানই লেখাপড়া করছে তাই তাদের শহরে নিয়ে আসেন নি বলে জানান সব হারিয়ে নিঃশ্ব হয়ে শহরে আসা এক সময়ের সফল এই কৃষক।

সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার তেরগাউয়ের কৃষক নয়ন মিয়া। এসেছেন কাজের সন্ধানে সিলেটে। বাড়িতে এক সন্তান, স্ত্রী ও মা’কে রেখে তিনি শহরে এসেছেন।

নিজের জমি নাই তাই পরের জমি ভাগি করে আগের জীবন ভালই কাটিয়েছেন। কিন্তু পরপর দুই বছর শিলাবৃষ্টি ও অকাল বন্যায় কষ্টের ধান তলিয়ে যাওয়ায় জমির প্রতি তার বিতৃষ্ণা এসেছে।

এর চেয়ে শহরে প্রতিদিন গতর খেটে রোজি করে সংসারের হাতে টাকা তুলে দেয়াতেই তিনি এখন স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। শীতের দিনে সকালে যখন গরু লাঙ্গল নিয়ে জমি চাষে যাওয়া কথা নয়ন মিয়ার তিনি তখন উড়া কোদাল নিয়ে কাজের জন্য টিলাগড় পয়েন্টে এসে অপেক্ষমান। কখন কোন বড় সাহেব এসে তাকে কাজের জন্য ডাক দিবেন।

আর সারাদিন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে সন্ধ্যায় আপন নীড়ে ফিরে আসবেন। পরিবারের সদস্যদের মুখে হাসি দেখলেই সব দুঃখ তার দুর হয়ে যায় এমনটাই বক্তব্য এই কৃষকের।

তারিখ আলী সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক উপজেলার সুতারখালীর বাসিন্দা। দুই ভাইয়ের সংসার থেকে গেলো বছর পৃথক হয়েছেন। এক সন্তান আর স্ত্রীকে নিয়ে তিনি এখন সব হারিয়ে যেন নিঃশ্ব।

নিজের কিছু জমির পাশাপাশি অন্যের জমিও ভাগি করেছিলেন। কিন্তু অকাল বন্যায় কষ্টের ফসল বিনষ্ট হওয়ায় তিনি এখন অনেকটা দিশেহারার মতই। তাই পরিবারের প্রিয় সদস্যদের গ্রামের বাড়ীতে রেখে তিনি এখন রোজীর সন্ধানে শহরে।

জানালেন জীবনে এত কষ্টের কাজ এবারই প্রথম। তবুও তাতে তিনি সন্তুষ্ট। কারন তার উপার্জনেই যে পরিবারের সদস্যদের মুখে হাসি ফুটে উঠে।

অর্ধবয়স্কা নারী জাহানারা বেগম থাকেন নগরীর চৌকিদেখীতে। তবে তার গ্রামের ঠিকানা দিতে আগ্রহী নয়। তিনিও এসেছেন কাজের সন্ধানে। তার সংসার নিয়েও আছে অনেক ট্রাজেডী।

বলতে চান না কিছুই। তবে তার অশ্রুসজল চোখ বলে দিয়েছে তিনিও ভাগ্য বিড়ম্বিত হয়ে আজ রোজির সন্ধানে পুরুষের সাথে সমানভাবে কাজে যোগ দিয়েছেন।

তিনি বলেন- কষ্ট সয়ে গেছি তাই এখন তার কষ্ট বলে মনে হয়না। সারাদিন কাজ করে মালিকের কাছ থেকে যখন নগদ টাকা হাতে পান তাতেই যেন আকাশের চাঁদ হাতে আসার উপক্রম। তবে তিনি প্রতিদিন কাজে আসেন না। একদিন করলে দুইদিন বসে থাকেন বলেও জানান।

ভাগ্য বিড়ম্বিত এইসব মানুষের জীবনের বাস্তব গল্প শুনে নিজের অজান্তেই চোখের কোনে জল জমে গেলো। অতঃপর পাশের একটি টং দোকান থেকে চা আর বনরুটি দিয়ে ১০ জনকে আপ্যায়ন করে বিদায় নিয়ে আসলাম।

আর চোখের সামনে যেন ভেসে উঠতে থাকলো তাদের জীবন সংগ্রামের না দেখা অধ্যায়গুলো। কামনা করলাম তাদের সুন্দর আগামীর জন্য।

জীবনের অন্ধকারময় রাত গুলো কেটে তাদের জীবনে যেন শীঘ্রই উঠে সফলতার সোনালী সুর্য। অতীতের দুঃখ ভুলে এসব মানুষগুলো যেন সামনে পথ চলে সফলতার সাথে।

শহরের শীতের সকাল গ্রামের মতো নয়। এখানে সকালের মিষ্টি আলো ফোটার আগেই কাকের কা-কা রবে শহরবাসীর ঘুম ভাঙে। তবু লেপের নিচে মিষ্টি উত্তাপে আবার ডুবে যায় গভীর ঘুমে।

যদিও এখানে গ্রামের মতো শীত এত তীব্র নয়। শহরে কল-কারখানা, গ্যাসের চুলা আর অতিরিক্ত ঘন বসতির কারণে এখানকার মানুষ বুঝতেই পারে না হাড় কাঁপানো শীতের কি যন্ত্রণা।

তবু বস্তি, ফুটপাত আর রেল স্টেশনের খোলা জায়গায় যেসব মানুষ ঘুমায়, তারা ঠক্ ঠক্ করে কাঁপতে থাকে। তাই তো সকালে সূর্যের তাপ তাদের শরীরের হিম কুয়াশা চুষে না নেওয়া পর্যন্ত তারা জাগতে পারে না। কেউ আবার জেগে ওঠে ছেঁড়া কাগজ জ্বেলে আগুন পোহায়।

আর এসব দৃশ্যের মাঝে হারিয়ে যায় গ্রাম থেকে শহরে আসা মানুষের জীবনের গল্প। জীবনের কঠিন সংগ্রামে অবতীর্ণ মানুষগুলোর জন্য যদি আমরা কিছু করতে পারি তাহলে তারাও একটি সুখী সংসার পাবে।

অসহায় কৃষকের জন্য বাংলাদেশের সরকার অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু সবাই সেই সুফল ভোগ করতে পারছেনা। পত্রিকার পাতা খুললেই স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা মোটা অংকের চাঁদার বিনিময়ে কৃষকদের ন্যায্য অধিকার দিচ্ছে।

এই অবস্থা চলতে দেয়া যায়না। বাংলাদেশ কৃষি নির্ভর দেশ। দেশের অর্থনীতির মুল অংশ জুড়েই কৃষকের বেশী অবদান। তাই কৃষক সমাজের দুঃখ দুর্দশা লাঘবে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন সংগঠন ও বিত্তবানদের এগিয়ে আসা উচিত। না হয় কৃষকরা কৃষি বিমুখ হলে দেশের অর্থনীতিতে এর মারাত্মক প্রভাব পড়বে।

এই সংবাদটি পড়া হয়েছে ৫৫৯ বার

Share Button

Callender

November 2024
M T W T F S S
 123
45678910
11121314151617
18192021222324
252627282930