শিরোনামঃ-

» ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে উগ্রপন্থিদের হাতে নিহতের তালিকা

প্রকাশিত: ২৭. এপ্রিল. ২০১৬ | বুধবার

সিলেট বাংলা নিউজ ডেস্কঃ অধিকাংশ ঘটনাতেই খুনিরা ধরা পড়েনি। প্রশ্ন উঠেছে, তাদের নেটওয়ার্ক গোয়েন্দারা খুঁজে পাচ্ছে না কেন? গোয়েন্দাদের অনেকেই তো বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছেন। সেই প্রশিক্ষণ কাজে আসছে না কেন? আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্তেই কি অবহেলা রয়েছে?
কমপক্ষে ৬ মাস ধরে পরিকল্পনা। এরপর ঘটনাস্থল পর্যাপ্ত পরিমাণে রেকি করা। সবশেষে টার্গেট করা ব্যক্তিকে তার বাসায় বা পথের মধ্যে চাপাতি দিয়ে ঘাড়ে, মাথায় কুপিয়ে হত্যা।
গত আড়াই বছরে এভাবেই অন্তত ১ ডজন ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়েছে। খুন হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, ব্লগার, মুক্তমনা লেখক, মানবাধিকার কর্মী।
এসব হত্যাকাণ্ডের কোনটিরও কোনো কূল-কিনারা করতে পারেনি আইন শৃঙ্খলা বাহিনী বা গোয়েন্দারা। তথ্য মিলছে না মূল হোতাদের বিষয়ে। খুনি চক্রও শনাক্ত হচ্ছে না। কেন এমনটি হচ্ছে—এ বিষয়ে জানতে চাইলে গোয়েন্দা সংস্থা সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, খুনি চক্রের শেকড় শনাক্ত করা যাচ্ছে না।
কিলিং মিশনে যারা অংশ নিচ্ছে তাদের দু-একজন ধরা পড়লেও তারা মূল হোতাদের ব্যাপারে কোন তথ্যই দিতে পারছে না। তারা শুধু একজনকেই চেনে। আর যাকে চেনে বলে নাম পরিচয় দেয় সেটিও নকল। ফলে খুনিরা যে তথ্য দিচ্ছে তা নিয়ে সামনে এগুনো যাচ্ছে না।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশিদ ইত্তেফাককে বলেন, ‘টার্গেট কিলিংয়ে যারা অংশ নিচ্ছে আমাদের আইন শৃঙ্খলা বাহিনী তাদের ধরতে পারছে না। আসলে গণতন্ত্রের একটা নমনীয়তা আছে। একটি গণতান্ত্রিক দেশে কাউকে ধরেই তো মেরে ফেলা যায় না।
বিচারের দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তাকে শাস্তি দিতে হয়। সারা বিশ্বে এই দূর্বলতার সুযোগ নেয় অপরাধীরা। এখানে পৃথক ট্রাইব্যুনাল করে এই অপরাধীদের বিচার করতে হবে। এসব হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বা গোয়েন্দাদের দায় নেই এটা বলা যাবে না।
আবার তারা হাত-পা গুটিয়ে বসে আছে সেটাও বলা যাবে না। এখন যেটা হচ্ছে সেটাকে আর স্লিপার সেলের কাজ বলা যাবে না। এটা তো আসলে কিলিং সেল। আগে একটা সময় ছিল আমাদের দেশের প্রতিটি মানুষ শীর্ষ সন্ত্রাসীদের ভয়ে তটস্থ ছিল। তাদের অপরাধে মানুষ অতিষ্ট হয়ে উঠেছিল।
আমরা তো সেই সন্ত্রাসীদের উত্খাত করতে পেরেছি। একটা সময় এই খুনিদেরও উৎখাত করা সম্ভব হবে। তা সময়ের ব্যাপার মাত্র। এ জন্য আমাদের নতুন পরিকল্পনা করতে হবে। সেভাবে মিশন নিয়ে কাজ করলে ওদের ধরা সম্ভব।’
রাজধানীর তেজগাঁও এলাকায় ব্লগার ওয়াসিকুর রহমান বাবু হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ২ খুনি চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসার তাফছীর বিভাগের ছাত্র জিকরুল্লাহ ওরফে জিকির ও মিরপুর দারুল উলুম মাদ্রাসার এবতেদীয়া শ্রেণীর দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আরিফুর রহমানকে হাতে নাতে ধরে ফেলেন কয়েকজন হিজরা।
যদিও ওই ২ মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ পরে দাবি করেছে, ওরা তাদের ছাত্র না। এই ২ খুনিকে নানাভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ ও গোয়েন্দারা।
কিন্তু তাদের কাছে থেকে পরিকল্পনাকারীদের ব্যাপারে কোন তথ্যই বের করা যায়নি। তারা জানিয়েছে, শুধু বেহেস্তে যাওয়ার জন্য ইসলাম বিরোধী বাবুকে তারা হত্যা করেছে। বাবুর অপরাধের বিষয়েও তারা কিছু জানে না।
এভাবেই মাদ্রাসার ছাত্রদের ধর্মের প্রতি অন্ধ বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহার করা হচ্ছে। গোয়েন্দারা এ পর্যন্ত তদন্ত করে যা পেয়েছেন তাতে দেখা গেছে, কিলিং মিশনে যারা অংশ নেবে তাদের পৃথক একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে সেখানে রাখা হচ্ছে।
কয়েক মাস ধরে পরিকল্পনা ও মহড়া শেষে তাদের কিলিং মিশনে পাঠানো হচ্ছে। সফলভাবে তারা সে মিশনও শেষ করছে। উগ্রপন্থীরা যাদের খুন করবে তাদের একটা তালিকাও তৈরি করেছে। সেই তালিকা ধরেই তারা খুন সংঘটিত করছে।

গত আড়াই বছরে অধ্যাপক এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকী, ব্লগার নাজিম উদ্দিন সায়েম, ওয়াশিকুর রহমান বাবু, ড. অভিজিৎ রায়, প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন, ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার, নিলাদ্রি চট্টপধ্যায়, অনন্ত বিজয়সহ অন্তত ১২ জন ব্লগার, মুক্তমনা লেখক, শিক্ষকসহ ক্ষুদ্রগোষ্ঠীর অধিকার নিয়ে আন্দোলন করা ব্যক্তি খুন হলেন।

অধিকাংশ ঘটনাতেই খুনিরা ধরা পড়েনি। প্রশ্ন উঠেছে, তাদের নেটওয়ার্ক গোয়েন্দারা খুঁজে পাচ্ছে না কেন? গোয়েন্দাদের অনেকেই তো বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছেন। সেই প্রশিক্ষণ কাজে আসছে না কেন? আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্তেই কি অবহেলা রয়েছে? বা গোয়েন্দারা কি হাত-পা গুটিয়ে বসে আছে?
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এখন কয়েকভাগে বিভক্ত। এক গ্রুপ ব্যস্ত অবৈধ অর্থ উপার্জনে। আরেক গ্রুপ রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বড় পদ নিয়ে বসে আছে। অনেকেরই রয়েছে দ্বৈত নাগরিকত্ব। স্ত্রী-সন্তানদের বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
আরেক গ্রুপ রয়েছে কোনঠাসা অবস্থায়। আর একটি গ্রুপ যারা সংখ্যায় খুব নগন্য তারা মন দিয়ে কাজ করার চেষ্টা করছেন।
একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইত্তেফাককে জানান, একটি গোয়েন্দা সংস্থার অনুসন্ধানে ইতিমধ্যে ধরা পড়েছে ইসরাইল ভিত্তিক গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের তত্পরতা রয়েছে বাংলাদেশে।
একটি ইসলামী সংগঠনের আন্তর্জাতিক সম্পাদক মোসাদের অনুসারীদের সঙ্গে বৈঠকও করেছে। এ নিয়ে এখন বিস্তারিত তদন্ত চলছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারকে বেকায়দায় ফেলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে আরো খুন হতে পারে।  এই চক্রান্তে এমন সব পরিবারের সম্পৃক্ততা পাওয়া যাচ্ছে যারা বিগত দিনে আওয়ামী লীগ সরকারের কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক ইত্তেফাককে বলেন, ‘পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বন্ধে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। পুলিশের বিভিন্ন সংস্থার পাশাপাশি গোয়েন্দা পুলিশও সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আশা করি খুব শিগগিরই আমরা ওদের নেটওয়ার্ক ধরে ফেলতে পারব। সব হত্যাকাণ্ডেরই বিচার হবে। খুনিরা সবাই ধরা পড়বে।’
উগ্রবাদীদের নিয়ে কাজ করা একজন নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলেন, ‘উগ্রবাদী গোষ্ঠী এতটাই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যে, তারা মুহুর্তেই নেটওয়ার্ক পরিবর্তন করে ফেলে। আর যাদের এই হত্যাকাণ্ডে ব্যবহার করা হচ্ছে তারা ধর্মের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত। তাদের বিশ্বাস যাদের হত্যা করার জন্য তাদের পাঠানো হয়ে, সেটি করতে পারলে মৃত্যুর পর তারা বেহেস্তে যাবে।
আসলে যাদের জীবনের মায়া নেই তারা রোখা কঠিন। এরা ধর্মীয়ভাবে অন্ধ। এই বিকৃত মস্তিস্কের মানুষদের সচেতন করতে না পারলে এই কিলিং বন্ধ করা কঠিন হবে।’
সর্বশেষ গত সোমবার রাজধানীর কলাবাগানে খুন হওয়া জুলহাজ মান্নান ও মাহবুব তনয়ের লাশের ময়নাতদন্তকারী চিকিত্সক ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সোহেল মাহমুদ সুত্রকে বলেন, ‘কোথায় আঘাত করলে দ্রুত মৃত্যু হয়, সেই প্রশিক্ষণ নিয়েই খুনিরা জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু মাহবুব তনয়কে কুপিয়েছে।
এ ধরনের আঘাতের পর কারও পক্ষেই বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। একই স্থানে উপর্যুপরি কয়েকটি আঘাত ছিল।’ তিনি বলেন, ‘শুধু এই হত্যাকাণ্ড নয়, আগের হত্যাকাণ্ডগুলোতেও খুনিরা একইভাবে কুপিয়েছে। দেখে মনে হয়, সবকটি খুনই একই গ্রুপের কাজ।’

এই সংবাদটি পড়া হয়েছে ৪৭৬ বার

Share Button

Callender

November 2024
M T W T F S S
 123
45678910
11121314151617
18192021222324
252627282930