শিরোনামঃ-

» যেভাবে রাগীব আলীকে বিশ্বাস করে ঠকেছিলেন ডা. পঙ্কজ কুমার

প্রকাশিত: ২০. মে. ২০১৬ | শুক্রবার

সিলেট বাংলা নিউজঃ চা বাগানের একজন হিসেবে রাগীব আলী ছিলেন তার প্রতিবেশী। তারাপুরের লাগোয়া মালনিছড়া চা বাগানের ইজারাদার রাগীব আলীর সঙ্গে সে সুবাদেই সম্পর্ক পঙ্কজ কুমার গুপ্তের।

পৈত্রিকসূত্রেই তারাপুর বাগান এলাকার দেবোত্তর সম্পত্তির সেবায়েত ডা. পঙ্কজ কুমার গুপ্ত। বাগান দেখভালের দায়িত্বেও ছিলেন তিনিই।

১৯৮৮ সালের দিকে চিকিৎসা শাস্ত্রে উচ্চতর শিক্ষা নিতে যুক্তরাজ্য যাওয়ার প্রাক্কালে বাগানটির দায়িত্ব দিয়ে যান প্রতিবেশী চা বাগানের কর্ণধার সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার কামালবাজার এলাকার রাশিদ আলীর ছেলে রাগীব আলীকে।

বাগানটির চাকা যাতে থেমে না যায় সে জন্যই আপাতত বাগানটি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন রাগীব আলীকে।

প্রতিবেশীর প্রতি সে বিশ্বাসই কাল হয় পঙ্কজ কুমার গুপ্তের জন্য। জালিয়াতির মাধ্যমে বিশ্বাসের সমাধি দিয়ে পুরো বাগানই দখল করে নেন রাগীব আলী।

তারাপুর বাগানটি একসময় ইংরেজ মালিকানায় ছিলো। স্টার টি গার্ডেন নামের সে বাগানটির মালিক ছিলেন বৃটিশ ব্যবসায়ী সি কে হার্ডসন।

তার মৃত্যুর পর ছেলে ডব্লিউ আর হার্ডসন বাগানের মালিকানা পান। ১৮৯২ সালের ১০ই জুন পঙ্কজ কুমার গুপ্তের বড়বাবা (দাদার বাবা) বৈকুণ্ঠ চন্দ্র গুপ্ত রেজিস্ট্রি দলিলের মাধ্যমে ডব্লিউ আর হার্ডসনের কাছ থেকে বাগানটি কিনে নেন।

২৩ বছর পর ১৯১৫ সালে বৈকুণ্ঠ চন্দ্রগুপ্ত সেখানে শ্রী শ্রী রাধাকৃষ্ণ জিউ দেবতা প্রতিষ্ঠা করে বাগানটি দেবতার নামে দলিলের মাধ্যমে উৎসর্গ করে দেন।

সেবায়েতের দায়িত্ব পান তারই ছেলে রাধালাল গুপ্ত। রাধালালের মৃত্যুর পর তার ২ ছেলে রবীন্দ্রনাথ গুপ্ত ও রাজেন্দ্রলাল গুপ্তের কাঁধে পড়ে সেবায়েতের দায়িত্ব। এরই মাঝে ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান সরকার বাগানটিকে অর্পিত সম্পত্তি ঘোষণা করে।

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক হানাদার বাহিনী হামলা চালায় তারাপুর চা বাগানে। পাকবাহিনীর হামলায় শহীদ হন রবীন্দ্রনাথ ও রাজেন্দ্রলাল ২ ভাই-ই।

তাদের সন্তানদেরও রেহাই মেলেনি। রবীন্দ্রগুপ্তের ছেলে রজত গুপ্ত, রাধালালের ২ ছেলে জহরলাল গুপ্ত ও রঞ্জিত কুমার গুপ্তও পাক বাহিনীর হামলায় শহীদ হন। বেঁচে যান কেবল ছোট ছেলে পঙ্কজ কুমার গুপ্ত।

দেশ স্বাধীনের পর আবার বাগানটি দেবোত্তর সম্পত্তির মর্যাদা পায়। স্বামী-সন্তানদের হারিয়ে অকুল পাথারে পড়েন রবীন্দ্রনাথ গুপ্তের স্ত্রী মুকুলবালা গুপ্ত ও রাধালালের স্ত্রী ছায়াগুপ্তা।

স্বজন হারানোর শোক আর বেঁচে থাকার সংগ্রামে দুর্বল হয়ে পড়েন তারা। পরিবারের একমাত্র পুরুষ সদস্য পঙ্কজ কুমারও অপ্রাপ্তবয়স্ক।

এক পুত্রবধূ সবিতা রানী গুপ্তকে সঙ্গে নিয়ে হাল ধরেন ২ জা। সংসার ও বাগান সামলানোর পাশাপাশি দেবতার সেবায়ও নিয়োজিত হন তারা।

১৯৭৬ সালে পঙ্কজ কুমারের কাঁধে সেবায়েতের দায়িত্ব দিয়ে কিছুটা নিশ্চিন্ত হন তারা।

পঙ্কজ কুমার তখন সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজের ছাত্র। পড়াশোনার পাশাপাশি বাগানের দায়িত্বও সামলাতে হয় তাকে।
১৯৭৯ সালে এমবিবিএস পাস করেন তিনি, যুক্ত হন চিকিৎসা পেশায়। চিকিৎসা শাস্ত্রে উচ্চতর ডিগ্রি নিতে ১৯৮৮ সালের দিকে তিনি পড়তে যান যুক্তরাজ্যের লিভারপুল স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড হাইজিনে।

তখন তিনি চা বাগানটি বিশ্বাসী ও দক্ষ কারো হাতে দিয়ে যেতে চান দেখভালের জন্য। প্রতিবেশী রাগীব আলীর ওপরই ভরসা করেন তিনি।

পাওয়ার অব অ্যাটর্নির মাধ্যমে আপাতত দায়িত্ব দেন তাকে। এ সময় বাগানের আয় নিজে বুঝে নেবেন এমন শর্তে রাগীব আলী ১২ লাখ টাকাও দেন পঙ্কজ কুমারকে। কথা ছিলো ফিরে এলে আবার বাগানটি বুঝে পাবেন পঙ্কজ কুমার।

পঙ্কজ কুমার বিদেশে থাকাকালীন সময়ে তারাপুর চা বাগান গিলে খাওয়ার চক্রান্ত করেন রাগীব আলী। জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে ইজারা দেখিয়ে বাগানটির দখল নিয়ে নেন তিনি।

১৯৯০ সালে পঙ্কজ কুমার যখন দেশে ফিরে আসেন রাগীব আলী তাকে জানান, সরকারের কাছ থেকে বাগানটি ইজারা পেয়েছেন তিনি।

পঙ্কজ কুমার প্রতিবাদ জানালে তাকে নানাভাবে ভয়ভীতি দেখানো হয়, হত্যার হুমকি দেয়া হয়।

সিলেটজুড়ে রাগীব আলীর ব্যাপক প্রভাব তখন, এরশাদ সরকারের শাসনের সে সময়ে সরকারি প্রভাব খাটানোর ক্ষমতাও ছিলো রাগীব আলীর হাতের মুঠোয়।

অসহায় পঙ্কজ কুমার তাই চুপ করে যান। বলতে গেলে অনেকটা অভিমানেই সিলেট ছেড়ে যান পঙ্কজ কুমার। শ্বশুরবাড়ি ফেনীতে ঠিকানা গাঁড়েন। সেখানে থেকেই চিকিৎসাসেবা চালিয়ে যান তিনি।

তার স্ত্রী শুভা গুপ্তও একজন চিকিৎসক। নারী রোগ বিভাগের মেডিকেল অফিসার হিসেবে ওসমানী মেডিকেল কলেজ থেকে অবসর নিয়ে এখন তিনিও আছেন চিকিৎসা সেবায়।

অন্যদিকে তারাপুর বাগানকে ঘিরে নানামুখী বাণিজ্যের জাল বিস্তার করেন রাগীব আলী।

বাগানের ভূমিতে আবাসন তৈরি করে বিক্রি করেন বিভিন্ন জনের কাছে। সেখানে গড়ে তুলেন নিজের ও স্ত্রীর নামে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সহ বিভিন্ন স্থাপনা।
অপরদিকে ‘দান দক্ষিণা’র মাধ্যমে নিজের একটা ইমেজও গড়ে তুলেন রাগীব আলী।
হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ, স্কুল-কলেজ, ব্যাংক-বীমা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজসেবী হিসেবে সবার শ্রদ্ধাও নিজের করে নেন।

ভুলিয়ে দেন অতীতের ইতিহাস। তবে আইন কিন্তু তার নিজের গতিতেই চলছিলো।

ধর্মের কল বাতাসে নড়ে উঠে এক সময়। রাগীব আলীর জালিয়াতির বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় উচ্চ আদালত তারাপুর বাগানটি আবার পঙ্কজ কুমারকেই ফিরিয়ে দিতে নির্দেশ দিয়েছেন।

ইতিমধ্যেই বাগানের একটি অংশ বুঝে পেয়েছেন পঙ্কজ কুমার গুপ্ত। তবে হাত-পা গুটিয়ে নেই অপর পক্ষ। অনেকটাই বেপরোয়া তারা। আদেশও মানছেন না উচ্চ আদালতের।

পঙ্কজ কুমার জানিয়েছেন- হাইকোর্ট ৭ দিনের মধ্যে সরকারের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ বাবদ নেয়া ৩০ লাখ ৭৬ হাজার ১৮৯ টাকা ২০ পয়সা ও চা রপ্তানি বাবদ আয়ের ৫ কোটি টাকা বুঝিয়ে দিতে বললেও এখনও একটি টাকাও জমা দেননি রাগীব আলী।

আদালতের আদেশের বিপরীতে তারা এখন ব্যস্ত যেকোন মূল্যে পঙ্কজ কুমারকে ঠেকাতে। পঙ্কজ কুমারকে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিতও করতে চাইছেন তারা।

অনেকটা আবেগমিশ্রিত কণ্ঠে পঙ্কজ কুমার বলেন, একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে আমার বাবা-কাকা-ভাইয়েরা শহীদ হয়েছেন।

বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠায় আমার রক্তের ঋণ রয়েছে অথচ আমাকেই ভিনদেশি নাগরিক সাজানোর চেষ্টা চলছে।

তবে তিনি মোটেই পরোয়া করছেন না কিছুরই। তার বিশ্বাস, সত্যের উপর কখনই অসত্যের প্রতিষ্ঠা হতে পারে না। উচ্চ আদালতের রায়কে তিনি এরই প্রমাণ মনে করছেন।

অনেক দিনের পর সত্য প্রতিষ্ঠা হওয়ায় বেশ তৃপ্তই আছেন পঙ্কজ কুমার গুপ্ত। তবে একটা দুঃখও আছে তার মনে, সে দুঃখের বিষয়টিও স্পষ্ট করেছেন তিনি।

নানাজনের কাছে শুনছেন তিনিই নাকি রাগীব আলীর সঙ্গে যোগসাজশের মাধ্যমে বাগানটি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।
এমন অধর্মের কথা ভাবতেই পারেন না তিনি। উল্টো নিজেই প্রতারণার শিকার হয়েছেন।
অপরাধ যদি তিনি কিছু করে থাকেন সেটা হচ্ছে কাউকে বিশ্বাস করার অপরাধ। বিশ্বাসের ঘরে যে কেউ এমন করে আঘাত করতে পারে তা তার ধারণাতেই ছিলো না।
-সৌজন্যে মানবজমিন

এই সংবাদটি পড়া হয়েছে ৫৩৩ বার

Share Button

Callender

November 2024
M T W T F S S
 123
45678910
11121314151617
18192021222324
252627282930